একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন আব্বা...
প্রকাশিত : ১৫:১৭, ১০ এপ্রিল ২০২৩ | আপডেট: ১৫:২২, ১০ এপ্রিল ২০২৩

আব্বা খুব রাগী ছিলেন। শুধু আমরা দুই ভাই বোনই না, খালাত, ফুফাতো ভাই বোনরাও ভয় পেতো তাকে। ভয়ংকর রকমের পড়াশোনা করানোর নেশা ছিলো তার। যাকেই দেখতেন শুধু পড়ার কথা বলতেন। আমাদের বাসায় কোন অতিথির সাথে বাচ্চারা আসলেও পড়তে বসিয়ে দিতেন। আর বিকেলে অংক করাতেন আব্বা। খেলার সাথীরা খোঁজ নিতে আসলে তাদেরও পড়তে বসাতেন। তাই ভয়ে অনেকে আসতো না। আর খেলার সময় দিতেন, যখন মাগরিবের আযান পড়ে যেতো। নিয়ম শৃঙ্খলা পালন করতে হতো কঠোরভাবে। আমরা দুপুরে যখন আব্বা আম্মা ঘুমাতেন, চুপি চুপি খেলতে বের হয়ে যেতাম।
আম্মাকে সবসময় সহোগীতা করতেন। সকল কাজে উৎসাহ দিতেন! বিশেষ করে বাইরের সমাজকল্যাণ মূলক কাজে। ঘরের কাজেও দেখেছি আম্মাকে সহযোগিতা করতে। সবচেয়ে বড় বিষয় যেটা এখন বুঝি কখনো নারী-পুরুষ বৈষম্য করতেন না।
কঠোর নিয়মের আরেকটি হলো পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা।
শীতের সকালে নদীতে গোসল করাতে নিয়ে যেতেন দুই ভাই বোনকে। ভাইয়া দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করতো, পারতো না। ব্যস, ধরে নিয়ে এসে গোসল।
পড়াশুনার প্রতি এত আবেগ আগ্রহ যা প্রতিফলন দেখতে চেয়েছিলেন আমাদের উপর। একটা ঘটনা বলি, ভাইয়া ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিলো। ভাইয়া ছাত্র হিসেবে তুখোড় মেধাবী। আব্বা খুব যত্ন করে নিজেই পড়াশুনা করালেন ভাইয়ারকে। তারপর ফলাফলের জন্য অপেক্ষা। একদিন গভীর রাতে ফলাফল এলো নেত্রকোনা জেলার থানা শহরের সেই ছোট্ট গ্রামে। ফলফলের পুরো তালিকায় ভাইয়ার নাম নেই। বৃত্তি পায়নি সে। পরিনামে সবার মন খারাপ হলো। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেলেন আব্বা। খুব রাগও করলেন ভাইয়ার উপর।
থেকে থেকে পুরো সপ্তাহ জুড়েই চললো বকাঝকা। এক বিকেলে আব্বার কলেজের একজন সহকর্মী হাতে কতগুলো কাগজ নিয়ে বাসায় এলেন। বৃত্তির ফলাফলের পূর্নাঙ্গ তালিকা। ভাইয়ার নাম আছে সে বৃত্তি পেয়েছে। খুশিতে সবাই আমরা হৈ হুল্লোর খাওয়া দাওয়া।
হঠাৎ দেখি বারান্দায় বেঞ্চে শুয়ে পড়েছেন আব্বা। কাঁদছেন তিনি!
হয়তো আনন্দের কান্না, হয়তোবা ছেলের মেধায় অবিশ্বাস করার কান্না।
তখন মফস্বল শহরে যে কোন কাগজ পৌঁছাতে কয়েকদিন লেগে যেত। ফলে, ফলাফলের বাকী অংশ আসলো তখন। দিনের পত্রিকা পেতাম রাত ১০টায় অনেকদিন ১২ টাও বেজে যেত।
না, এরপরও থেমে থাকেন নি। ক্লাস এইটের বৃত্তি বই ধরিয়ে দিয়েছেন সদ্য ফাইভ পাস করা ছেলেকে। আব্বা খুব চাইতেন আমরা দ্রুত বড় হয়ে যাই, পড়াশুনায় খুব ভালো করি। তিনি ছিলেন আলোকিত মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণ ইতিহাসে এম এ করেছেন। কলেজের শিক্ষক ছিলেন, নিজের সাবজেক্টের সাথে ইংরেজীও পড়াতেন। নিজের ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা শিখাতে ধৈর্য্যর শেষ ছিলো না তার।
আম্মা প্রায়ই গল্প করেন, একবার আমাকে সালোয়ার কামিজ পড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দেখছিলেন। বড় হয়ে আমাকে দেখতে কেমন লাগবে!
আব্বা হেরে গেলেন জীবনের কাছে। কিছুদিন পরেই লিভার সিরোসিসে ( যকৃৎতের ) হারালাম আব্বাকে।
আব্বা যেদিন মারা গেলেন সেদিন ১৫ রোজা। সকাল থেকে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল আব্বার। বিকেল চারটায় মারা গেলেন।
দুই একদিন পরই আমি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম ঈদে কি পোশাক পড়বো তাই নিয়ে। আব্বা আর কোনদিন ফিরবেন না, আমরা যে এতিম হয়ে গেছি সেটাও বুঝিনি তখন!
আব্বাকে হারিয়েছি অনেকদিন! আব্বার শখ পূরণ করেছে ভাইয়া। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছে। বিশ্বের ২৩ টিরও বেশি দেশে সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছে। রয়েছে সমৃদ্ধ গবেষণা। আব্বা'র নাজমুল এখন ডক্টর নাজমুল। কিন্তু আফসোস, দেখে যেতে পারলেন না।
এসবি/